কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ পরীক্ষায় টপার হয়েও বৈষম্যের শিকার হয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি পান নি ভাষাতত্ত্ববিদ, কবি ও সাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থানার কর্ণসুবর্ণর কাছে ডাবকাই গ্রামের ভূমিপুত্র। কবি শঙ্খ ঘোষের সহপাঠি ও অভিন্ন হৃদয় বন্ধু।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ বাংলায় টপার হয়েও বৈষম্যের কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি পান নি ১৯৫৮ সালেই। তারপর দেশ ত্যাগ। সহপাঠি বন্ধু কবি শঙ্খ ঘোষকে তুমি থেকে যাও আমার দেশে। আমি চললাম তোমার দেশে। কবি শঙ্খ ঘোষের মুখেও তার কথা শুনেছিলাম কয়েকবার। বহরমপুর খাগড়া ঘাট স্টেশন থেকে কাটোয়া গামী ট্রেনে কর্ণসুবর্ণ স্টেশন থেকে রামনগর -কান্দী রাজ্য সড়কে টেকারে কিছুদূর গেলেই ডাবকাই গ্রাম। অথবা বহরমপুর থেকে কান্দী গামী রাস্তায় বাসে খোসবাসপুরে নেমেই রামনগরগামী বাস বা টেকারে করে ডাবকাই গ্রাম।
এই গ্রামেই আনোয়ার পাশা জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের ১৫ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন তিনি নিখোঁজ হন। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকার মীরপুরে তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদের সামনেই তার কবর রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফরে গেলে সেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র বলে আমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে গিয়েছিল।
আমরা যারা মাদ্রাসা নিয়ে মুখ শিটকাই, তারা হয়তো জানেন না, আনোয়ার পাশা মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থানার বিখ্যাত ভাবতা আজিজিয়া মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক পরিক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে পাশ করেন ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে আই এ-তে ও প্রথম শ্রেণী। তারপর রাজশাহী কলেজ থেকে ভালো নম্বর নিয়ে ১৯৫১ সালে বিএ পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে ১৯৫৩ সালে বাংলায় এম এ-তে টপার হন । ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো পরীক্ষা দিয়েও বৈষম্যের শিকার হয়ে অধ্যাপনার চাকুরি পাননি। তার আগে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা বা সরকারি পদে চাকুরি করলেও তার মন খারাপ হয়ে যায়। তারপর ১৯৫৮ সালেই তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের পাবনা চলে যান। সেখানে পাবনার এডুয়ার্ড কলেজে অধ্যাপনার চাকুরিতে যোগ দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ওখানে গিয়েও আনোয়ার পাশা মুক্তিযুদ্ধের কাজ করেন ও লেখালেখি করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাকে তুলে নিয়ে যায় পাক-বাহিনী। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি তার লাশ পাওয়া যায় মীরপুরের এক ডেরা থেকে। ভাবতার মোশারফ হোসেন ভাই , যিনি আনোয়ার পাশার মাসতুতো ভাই-এর ছেলে, তার সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয়। পরে তিনি আমাকে ফোন দিলে যোগাযোগ করি। তিনিই আমাকে অনেকটাই বলেন। আসলে সবদেশেই সংখ্যালঘুরা বিপন্নতা ও বৈষম্যের শিকার হন।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, এই ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদ্রাসার ছাত্র মফিজুর রহমান একজন তরুণ পরমাণু বিজ্ঞানী। ভারতের পরমাণু গবেষণাকে আরো শ্রীবৃদ্ধি ও শক্তিশালী করতে মনযোগী।
আনোয়ার পাশার মৃত্যুর পর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা রাইফেল -রোটি-আওরাত নামক উপন্যাস। এই উপন্যাস জনপ্রিয় করলেও তার আরো অনেক গ্রন্হ রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল , নদী নি:শেষিত(১৯৬৩), রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা(১৯৬৩), নীড় সন্ধানী(১৯৬৮), নিশুতি রাতের গাথা(১৯৬৮), সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল((১৯৬৮), নিরুপায় হরিণী(১৯৭০), সমুদ্র শৃঙ্খল উজ্জ্বয়িনী ও অন্যান্য কবিতা(১৯৭৪)।
খুলনা গেজেট/এমএনএস